তাসাউফ ও বায়আতের গুরুত্ব
ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কোরআন হাদীছ ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।
এ প্রসঙ্গে প্রথমে আমি মহান কোরআনুল কারীমের আয়াত শরীফ উল্লেখ করছি। আল্লাহ পাক বলেন –
ﻟﻘﺪ ﻣﻦ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﺍﺫ ﺑﻌﺚ ﻓﻴﻬﻢ ﺭﺳﻮﻻ ﻣﻦ ﺍﻧﻔﺴﻬﻢ ﻳﺘﻠﻮﺍ ﻋﻠﻴﻬﻢ ﺃﻳﺘﻪ ﻳﺰﻛﻴﻬﻢ ﻭ ﻳﻌﻠﻤﻬﻢ ﺍﻟﻜﺘﺐ ﻭﺍﻟﺤﻜﻤﺔ ﻭ ﺍﻥ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻣﻦ ﻗﺒﻞ ﻟﻔﻰ ﺿﻠﻞ ﻣﺒﻴﻦ -
(লাকাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু’মিনীনা ইঁজ বা’আছা ফীহিম রাছুলাম মিন আনফুছিহিম ইয়াতলু আলাইহিম আ-ইয়াতিহী ওয়া ইয়ূজাক্কিহিম ওয়া ইয়ূ আল্লীমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাহ ওয়া ইন কানু মিন কাবলু লাফী দ্বালা-লিম মুবীন)।
অর্থাৎ, মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড়ই ইহসান যে তাদের মধ্যে হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাকের আয়াতগুলো তেলায়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাজকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিল না। (সূরা আল এমরান, আয়াত-১৬৪)
অনুরূপভাবে, সুরা বাকারা’র ১২৯ ও ১৫১ নং আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আয়াতে কারীমার উল্লেখ আছে। মূলতঃ উল্লেখিত আয়াত শরীফে বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে: তন্মধ্যে আয়াত শরীফ তেলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া, এ তিনটি বিষয় হচ্ছে এলমে জাহির বা ইলমে ফিকাহ এবং ইলমে মারেফতের অন্তর্ভুক্ত। যা এবাদাতে জাহের বা দ্বীনের যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন যাপনে হালাল কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে তাজকিয়ায়ে “ক্বলব”, অর্থাৎ, অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। মুফাসসিরীনে কিরামগণ “ইউযাক্কীহিম”-এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব, যেমন তাফসীরে জালালাইন-কামালাইন, বায়হাকী, ইবনে কাছীর, রুহুল বয়ান, তাফসীরে মাযহারী, মা’রেফুল কোরআন-সহ আরও অনেক তাফসীরে তাজকিয়ায়ে ক্বলব বা অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ করাকে ফরজ বলেছেন এবং তজ্জন্যে এলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসিরে ফকিহুল উম্মত হযরত মাওলানা শায়খ ছানাউল্লাহ পানি পথি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’-তে উল্লেখ করেন, যে সকল লোক ইলমে লা-দুন্নী বা ইলমে তাছাউফ হাছিল করেন তাঁদেরকে সূফি বলে। তিনি ইলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ আইন বলেছেন। কেননা, ইলমে তাছাউফ মনকে বা অন্তঃকরণকে গায়রুল্লাহ হতে ফিরিয়ে আল্লাহ পাকের দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা আল্লাহ পাকের হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং ক্বলব্ বা মন থেকে বদ খাছলত-সমূহ দূর করে নেক খাছলত-সমূহ পয়দা করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়।
আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য ইলমে তাসাউফ যে ফরজ, এ প্রসঙ্গে আফজালুল মুফাসসিরীন আল্লামা হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) তাঁর ‘তাফসীরে রুহুল বয়ানে’ উল্লেখ করেন যে, দ্বিতীয় প্রকার ইলম হচ্ছে ইলমে তাছাউফ যা ক্বলব বা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য ফরজ।
এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ হওয়া সম্পর্কে ‘জামিউল উসুল’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, এলমে তাছাউফ বদ খাছলত-সমূহ হতে নাজাত বা মুক্তি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। পক্ষান্তরে, আল্লাহ-প্রাপ্তি, রিপু বিনাশ ও সংযম শিক্ষার একমাত্র পথও। এই জন্য ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজে আইন।
মূলতঃ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফত, এ সবের প্রত্যেকটি-ই কোরআন সুন্নাহসম্মত এবং তা মানা ও বিশ্বাস করে কার্যে পরিণত করা কোরআন-সুন্নাহ’র-ই নির্দেশের অর্ন্তভুক্ত।
আল্লাহপাক তাঁর কালাম পাকে এরশাদ করেন –
ﻟﻜﻞ ﺟﻌﻠﻨﺎ ﻣﻨﻜﻢ ﺷﺮﻋﺔ ﻭ ﻣﻨﻬﺎﺟﺎ “লি-কুল্লিন-জ্বায়াল না মিনকুম শির’আতাউ ওয়া মিনহাজ”।
অর্থাৎ, আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত, অপরটি তরীকত-সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। (সূরা মাইয়িদা, আয়াত ৪৮)
আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে আরও এরশাদ করেন –
ﻭ ﺍﻥ ﻟﻮﺍﺳﺘﻘﺎﻣﻮﺍ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻄﺮﻳﻘﺔ - (ওয়া আল লাওয়িস্তেকামু আলাত তারীকাতে- সূরা জ্বিন আয়াত ১৬)
অর্থাৎ, তারা যদি তরীকতে (সঠিক পথে) কায়েম থাকতো। অতএব, তরীকত শব্দটি কোরআন শরীফে রয়েছে।
আর হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে –
ﺍﻟﺸَّﺮﻳﺔٌ ﺷَﺠﺮَﺓٌ ﻭَ ﺍﻟﻄَّﺮِﻳﻘَﺔُ ﺍَﻏﺼَﺎﻧُﻬَﺎ ﻭَ ﺍﻟﻤَﻌﺮِﻓَﺔُ ﺍَﻭﺭَﻗُﻬَﺎ ﻭَ ﺍﻟﺤَﻘِﻴﻘَﺔُ ﺛَﻤَﺮُﻫَﺎ –
অর্থাৎ, শরীয়ত একটি বৃক্ষস্বরূপ, তরীকত তার শাখা প্রশাখা, মারেফাত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল । (সিসরুল আসরার)
হাদীস শরীফে আরও এরশাদ হয়েছে –
ﺍَﻟﺸَّﺮِﻳﻌَﺔُ ﺍَﻗﻮَﺍﻟِﻰ ﻭَ ﺍﻟﻄَّﺮِﻗَﺔُ ﺍَﻓﻌَﺎﻟِﻰ ﻭَﺍﻟﺤَﻘِﻴﻘَﺔُ ﺍَﺣﻮَﺍﻟِﻰ ﻭَﺍﻟﻤَﻌﺮِﻳﻔَﺔُ ﺍَﺳﺮَﺍﺭِﻯ -
অর্থাৎ, শরীয়ত হলো আমার কথাসমূহ (আদেশ-নিষেধ), তরীকত হলো আমার কাজসমূহ (আমল), হাকীকত হলো আমার গুপ্ত রহস্য। (ফেরদাউস)
উল্লেখ্য যে, উক্ত শিক্ষা বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এমন কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া, যিনি ফয়েজ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এখন প্রশ্ন হলো, এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে?
তরীকত যথাযথভাবে পালন করতে হলে দ্বীনী এলেম অর্জন করতে হবে যা ফরজ। এই এলেম দু’প্রকার- ১) ইলমে ফিকাহ, ২) ইলমে তাছাউফ।
ইলমে ফিকাহ: ইলমে ফিকাহ দ্বারা এবাদাতে জাহেরা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। ইলমে তাছাউফ-এর দ্বারা এবাদাতে বাতেন বা অভ্যন্তরীন অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়ে ইখলাছ অর্জিত হয়। এ মর্মে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে –
ﻋﻦ ﺍﻟﺤﺴﻦ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻋﻠﻤﺎﻥ ﻓﻌﻠﻢ ﻓﻰ ﺍﻟﻘﻠﺐ ﻓﺬﺍﻙ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺍﻟﻨﺎﻓﻊ ﻭ ﻋﻠﻢ ﻋﻠﻰ ﻟﻠﺴﺎﻥ ﻓﺬﺍﻟﻚ ﺣﺠﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﻏﺰ ﻭ ﺟﻞ ﻋﻠﻰ ﺍﺑﻦ ﺍﺩﻡ -
(আনিল হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্বালা আল এলমু এলমানে ইলমু ফিল ক্বালবে ফাজাকাল ইলমুন নাফেউ ওয়া ইলমুল আলাল লেছানি ফাজাকা হুজ্জাতুল্লাহে আলা এবনে আদামা)। অর্থাৎ, এলেম দু’প্রকার (১) ক্বালবী এলেম। এটা হলো উপকারী এলেম। (২) লিসানী বা জবানী এলেম। এটা হলো আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আদম সন্তানদের প্রতি দলীলস্বরূপ। (মিশকাত শরীফ)
আর এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিকী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম, ইমামুল আইম্মা রঈসুল মুহাদ্দিসীন ফখরুল ফুকাহা শায়খুল উলামা হযরত ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন –
ﻣَﻦ ﺗَﻔَﻘَّﻪَ ﻭَ ﻟَﻢ ﻳَﺘَﺼَﻮَّﻑَ ﻓَﻘَﺪ ﺗَﻔَﺴَّﻖَ ﻭَ ﻣَﻦ ﺗَﺼَﻮَّﻑَ ﻭَ ﻟَﻢ ﻳَﺘَﻔَﻘَّﻪَ ﻓَﻘَﺪ ﺗَﺰَﻧﺪَﻕَ ﻭَ ﻣَﻦ ﺟَﻤَﻊَ ﺑَﻴﻨَﻬُﻤَﺎ ﻓَﻘَﺪ ﺗَﺤﻀﻘَّﻖَ-
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এলেম ফিকাহ (জবানী এলেম) অর্জন করলো, কিন্তু এলেম তাছাউফ (ক্বালবী) এলেম অর্জন করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফের দাবি করে, কিন্তু শরীয়ত স্বীকার করেনা, সে ব্যক্তি যিন্দীক (কাফের); আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার এলেম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মুহাক্কিক তথা মু’মিনে কামেল। (মিরকাত, কিতাবুল ইলম)
অর্থাৎ, এলমে ফিকাহ ও এলমে তাছাউফ উভয় প্রকার এলেম অর্জন করে দ্বীনের ওপর সঠিকভাবে চলার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। বর্তমান মুসলমানের কাছে আসল সত্য জিনিস বা শিক্ষা না থাকাতে মানুষ প্রকৃত মু’মিন হতে পারছে না। কেবল মাত্র ক্বলব নামের অমূল্য রত্নটা হস্তগত করতে জীবনের সব সময়ই চলে যায়, তবে মানুষ খাঁটি ঈমানদার হবে কবে। এ জন্য আমরা চিন্তা ফিকির করি না। তরীকতের এমন সরল সহজ পথ অবলম্বন করা দরকার যাতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে উক্ত নেয়ামত পেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত নেয়ামত বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া। এখন প্রশ্ন হলো তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে? কেননা উছুল-ই রয়েছে যে আমলের দ্বারা ফরজ পূর্ণ হয় এবং সেই ফরজকে পূর্ণ করার জন্য সে আমল করাও ফরজ। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন: যেমন এ প্রসঙ্গে “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে, যে আমল ব্যতিরেকে ফরজ পূর্ণ হয় না বা আদায় হয় না, সে ফরজ আদায় করার জন্য সে আমলটাও ফরজ। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নামাজ আদায় করা ফরজ। আর এ নামাজ আদায় হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা, অর্থাৎ, ওজু। যখন কেউ নামাজ আদায় করবে, তখনই তার জন্য ওযু করা ফরজ হয়ে যাবে। যেহেতু ওজু ছাড়া নামাজ হবে না, ঠিক তদ্রুপ-ই এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ। আর বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর হাদীস শরীফের ভাষায় এ ধরণের ফরজকে অতিরিক্ত ফরজ বলে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই উক্ত হাদিসে বর্ণিত অতিরিক্ত ফরজের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাজহাব মানা, বাইয়া’ত হওয়া ইত্যাদি।
বস্তুতঃ পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হতে হবে। এটা মহান আল্লাহ পাকের কালামে অসংখ্য আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত। যদি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহাজ্ঞানী ব্যক্তিবর্গগণ নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য না মানেন, তবে কার কী বলার আছে। তাদেরকে যতোই বোঝানো হউক না কেন, কিছুতেই তারা বোঝার চেষ্টা করবে না; বা বুঝতে সক্ষম হয় না। তাদের ক্বালবে সীলমোহর মারা আছে।
সূফীকুল শিরোমনি আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ:) বলেন –
‘ইলমে জাহের হাম চুঁ মসকা, ইলমে বাতেন হাম চুঁ শীর
কায় বুয়াদে বে শীরে মসকা, কায় বুয়াদে বেপীরে পীর’।
অর্থাৎ, ইলমে জাহের জানো দুধের মেছাল (উপমা), আর বাতেন জানো মাখনের মেছাল, দুধ ছাড়া মাখন কীভাবে হয় আর পীরের আনুগত্য ছাড়া পীর কীভাবে হয়। (মসনবী শরীফ)
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেন –
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
(ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আ-মানুত্তাক্কুলা ওয়া কুনু মা’আছ্ছাদিকীন)।
অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় করো, আর ছাদেকীনদের সঙ্গী হও” (সূরা তওবা, আয়াত-১১৯)। এ আয়াত পাকে আল্লাহ পাক মূলতঃ পীর-মাশায়েখগণের সঙ্গী বা সোহবত এখতিয়ার করার কথা বলেছেন। কারণ হক্কানী মুর্শিদগণ-ই হাকীকি ছাদেকীন।
আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা কোরআন শরীফের প্রথম সূরাতেই শিখিয়ে দিচ্ছেন –
ﺍﻫْﺪِﻧَﺎ ﺍﻟﺼِّﺮَﺍﻁَ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﺻِﺮَﺍﻁَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻤْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ
অর্থাৎ, আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তাঁদের পথ যাঁদেরকে তুমি নিয়া’মত দান করেছো। {সূরা ফাতিহা, ৬-৭}
সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন, সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম।
আর তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা হলেন –
ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀِ ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ
অর্থাৎ, যাদের ওপর আল্লাহ তা’আলা নিয়ামত দিয়েছেন, তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার বান্দাগণ। {সূরা নিসা, ৬৯}
এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ তথা আল্লাহ’র অলীগণ।যাঁদের শানে আল্লাহ্ নিজেই ঘোষণা দেন –
ﺃﻻَ ﺍِﻥَّ ﺍَﻭﻟِﻴﺎَﺀ ﺍﻟﻠﻪِ ﻻَ ﺧَﻮﻑٌ ﻋَﻠَﻴﻬِﻢ ﻭَﻟَﺎﻫُﻢ ﻳَﺤﺰَﻧُﻮﻥ -
অর্থাৎ, সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ’র অলী বা বন্ধুগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো চিন্তা-পেরেশানী নেই। (সূরা ইউনূস, ৬২)
আর ওই সকল প্রিয় বান্দাদের পথ-ই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ, তাঁদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা হয়ে যাবে। যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়ত-তরীকতপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলাটা হবে সবচেয়ে সহজ। আর একজন শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করার নাম-ই হল পীর-মুরিদী বা তাসাউফ অর্জন ও বাইয়া’ত গ্রহণ।
আল্লাহ পাক তাঁর পাক কালামে আরো এরশাদ করেন —
ﻳﺎ ﺍﻳﻬﺎ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﺍﻣﻨﻮﺍ ﻭﺍﺑﺘﻐﻮﺍ ﺍﻟﻴﻪ ﺍﻟﻮﺳﻴﻠﺔَ ﻭَ ﺟَﺎﻫِﺪُﻭﺍ ﻓِﻰ ﺳَﺒِﻴﻠِﻪَ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢ ﺗُﻔﻠِﺤُﻮﻥ -
(ইয়া আইয়্যূলহাল্লাজীনা আ-মানুত্তা কুল্লাহা অবতাগু ইলাইহিল অছিলাতা অ জ্বা-হিদু ফি ছাবিলিহী লা’আল্লাকুম তুফলিহুন)। অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহপাককে ভয় করো, আর তাঁর সন্তষ্টি লাভের জন্য উছিলা গ্রহণ করো (সুরা মায়িদা, আয়াত-৩৫)।
মুফাসসিরীনগণ বলেন, উল্লেখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত উছিলা দ্বারা তরীকতের মাশায়েখগণকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে -‘আল ওয়াসলু লা ইয়াহছিলু ইল্লা বিল উছিলাতে ওয়াহিয়া ওলামায়ে মুহাক্কেকীনা ওয়া মাশায়েখুত তরিকত’, অর্থাৎ, উক্ত আয়াতে উছিলা ছাড়া উদ্দেশ্যকে (আল্লাহ্কে) লাভ করা যাবেনা, আর সে উছিলা হলো মুহাক্কীক আলেম বা যিনি তরীকতের শায়খ বা পীর। যদিও অনেকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান সদকা, জিহাদ ইত্যাদিকে উছিলা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাকিকতে পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা। কারণ পীর-মাশায়েখগণের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তাজকিয়া নাফস বা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয় না। আর আত্মশুদ্ধি ব্যতিরেকে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ, তাবলীগ কোনো কিছুই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয় না বা নাজাতের উছিলা হয় না। তাই দেখা যাবে অনেক লোক নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান ছদকা, জিহাদ, তাবলীগ ইত্যাদি করেও এক লাফে জাহান্নামে যাবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, ﻓﻮﻳﻞ ﻟﻠﻤﺼﻠﻴﻦ (ফাওয়াইলুল্লিলমুছাল্লিন); অর্থাৎ, মুসুল্লীদের জন্য জাহান্নাম (সূরা মাউন, আয়াত-৭)। কোন মুসুল্লী জাহান্নামে যাবে – যে মুছল্লী তাজকিয়ায়ে নাফসের মাধ্যমে অন্তর থেকে রিয়া দূর করে “ইখলাছ” হাছেল করেনি, তাই সে মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করছে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেনি। আল্লাহ বলেন, “আল্লাজিনা হুম ইউরা-উন”। অর্থাৎ, তারা ওই নামাজি যারা রিয়ার সহকারে নামাজ আদায় করেছে (সূরা-মাউন, আয়াত-৬)।
একটি হাদীছ শরীফ উল্লেখ করলাম যাতে আপনারা বুঝতে পারেন। মুসলিম শরীফের ছহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে কেয়ামতের দিন শহীদ, দানশীল ও দ্বীন প্রচারকারী আলেম, এ তিন প্রকার লোক থেকে কিছু লোককে সর্বপ্রথম জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেহেতু তারা এখলাছের সাথে জিহাদ, তাবলীগ, দান ছদকা ইত্যাদি করেনি। যে সব আলেম বলে থাকে কোরআন শরীফে বর্ণিত উছিলা হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন: তাহলে নামাজ আদায় করে জিহাদ করে ইলিয়াছি তাবলীগ করেও বান্দা জাহান্নামে যাবে কেন? কেনো উক্ত আমলসমূহ তার জন্য নাজাতের উছিলা হলো না? নিশ্চয়ই আপনারা বলবেন, তাদের এখলাছ ছিল না। কেন এখলাছ ছিল না? তারা কামেলে-মোকাম্মেল পীরের কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করে এখলাছ অর্জন করেনি। তাহলে বোঝা গেল, পীর-মাশায়খগণ হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা, তথা উছিলাসমূহের উছিলা। কারণ তাঁদের কাছে বাইয়া’ত হওয়ার উছিলাতেই এছলাহ লাভ হয়, এখলাছ অর্জিত হয়। যার ফলে নামাজ, রোজা, জিহাদ, দান খয়রাত ইত্যাদি কবুল হয় বা নাজাতের উছিলা হয়।
কামেল পীর-মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন –
ﻣﻦ ﻳﻬﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻬﻮ ﺍﻟﻤﻬﺘﺪ ﻭ ﻣﻨﻴﻀﻠﻞ ﻓﻠﻦ ﺗﺠﺪ ﻟﻪ ﻭﻟﻴﺎ ﻣﺮﺷﺪﺍ -
(মাই ইয়াহদিল্লাহু ফাহুয়াল মুহতাদে ওয়ামাই ইয়ুদ্বলিল ফালান তাজিদালাহু ওলিইয়্যাম মুর্শেদা)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক তাকে হেদায়ত দেন, আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে সে কখনও অলিয়ে কামেল মুর্শিদ খুঁজে পাবে না (সূরা-কাহাফ, আয়াত-১৭)। উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা মূলতঃ এটাই বোঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি কোনো কামেল-মোকাম্মেল পীর সাহেবের কাছে বাইয়া’ত হয়নি, সে ব্যক্তি গোমরাহ।
আল্লাহ্ পাক আরও মুর্শিদের আনুগত্যের বিষয়ে এরশাদ করেন –
ﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪ ﻭَﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ ﻭَﺃُﻭﻟِﻰ ﺍﻵَﻣﺮِ ﻣِﻨﻜُﻢ -
অর্থাৎ, আনুগত্য করো আল্লাহ’র, আনুগত্য করো রাসূলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে হুকুমদাতা। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯)
উক্ত আয়াতে কারীমায় ‘ তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা (উলিল আমর)’ দ্বারা শরীয়ত ও তরীকতের আলেমকে বোঝানো হয়েছে। এটাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত।
আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- ﻳﻮﻡ ﻧﺪﻋﻮﺍ ﻛﻞ ﺍﻧﺎﺱ ﺑﺎﻣﺎﻣﻬﻢ অর্থাৎ, সেই দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের (শায়খের) নামে আহ্বান করবো। (সূরা বনি ইসরাঈল)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে “আ’রায়েসুল বয়ান”-এ উল্লেখ রয়েছে, “ওয়া ইয়াদ’উল মুরীদিনা বে আসমায়ে মাশায়েখেহীম”। অর্থাৎ, হাশরের দিন প্রত্যেক মুরীদকে ডাকা হবে যার যার শায়খ বা পীরের নামে। তাই পীরের দলভুক্ত হয়ে আল্লাহ’র দরবারে হাজিরা দিতে হবে।
বাইয়াত
“বাইয়া’ত” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “বাইয়ু’ন” শব্দ থেকে।“বাইয়ু’ন” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “ক্রয়-বিক্রয়”। এখানে এই “ক্রয়-বিক্রয়” মানে হচ্ছে আমার আমিত্বকে আল্লাহর রাহে রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে কোরবান করে দিলাম, বিলীন করে দিলাম, বিক্রি করে দিলাম। আমার আমিত্ব, আমার যতো অহংকার আছে, অহমিকা আছে, আমি আমি যতো ভাব আছে, সমস্ত কিছু আল্লাহর রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে আল্লাহর রাহে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়া, কোরবান করে দেয়া, বিক্রি করে দেয়া, এবং পক্ষান্তরে, রাসূল (স:)-এর কাছ থেকে কোরআন সুন্নাহ-ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা খরিদ করে, সমস্ত উপাসনার মালিক আল্লাহ, এবাদতের মালিক আল্লাহ, কুল মখলুকাতের মালিক আল্লাহ, এই দৃঢ় ঈমানে ঈমানদার হয়ে যাওয়া, এটাকেই বলা হয় বাইয়াত বা “ক্রয়-বিক্রয়”।
আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত এরশাদ করেন –
ﺁَ ﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﺍَﺷﺘَﺮَﻯ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻤُﺆﻣِﻨِﻴﻦَ ﺍَﻧﻔُﺴَﻬُﻢ ﻭَ ﺍَﻣﻮَﺍﻟَﻬُﻢ ﺑِﺎَﻥَّ ﻟَﻬُﻢُ ﺍﻟﺠَﻨَّﺔَ ﻳُﻘَﺎﺗِﻠُﻮﻥَ ﻓِﻰ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻴَﻘﺘُﻠُﻮﻥَ ﻭَ ﻳُﻘﺘَﻠُﻮﻥَ ﻭَﻋﺪَﺍ ﻋَﻠَﻴﻪِ ﺣَﻘَّﺎ ﻓِﻰ ﺍﻟﺘَّﻮﺭﺓ ﻭَﺍﻻِﻧﺠِﻴﻞِ ﻭَﺍﻟﻘُﺮﺃﻥِ ﻭَ ﻣَﻦ ﺍَﻭﻓﻰ ﺑِﻌَﻬﺪِﻩِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﺎﺳﺘَﺒﺸِﺮُﻭﺍ ﺑِﺒَﻴﻌِﻜُﻢُ ﺍﻟَّﺬِﻯ ﺑَﺎﻳَﻌﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﻭَ ﺫًﺍﻟِﻚَ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻔًﻮْﺯُ ﺍﻟْﻌَﻈِﻴﻢُ -
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, কখনও হত্যা করে এবং কখনও নিহত হয়। তাওরাত ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আল্লাহর চাইতে নিজের ওয়াদা অধিক পালনকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ করো তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর তা হলো মহা সাফল্য। (তাওবা:১১১)
ﻟَﻘَﺪ ﺭَﺿِﻰَ ﺍﻟﻠﻪ ﻋَﻦِ ﺍﻟﻤُﺆﻣِﻨِﻴﻦَ ﺍِﺫ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻧَﻚَ ﺗَﺤﺖَ ﺍﻟﺸَّﺠَﺮَﺓِ -
অর্থাৎ, হে রাসূল! আল্লাহ মু’মিনদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল। (সূরা ফাতহা : ১৮)
* যে ব্যক্তি তার ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পূর্ণ করবে এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করবে, সে আল্লাহ পাকের প্রিয়জন হবে। আর নিশ্চিতভাবে আল্লাহ পাক মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান: ৭৬)
o ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻧَﻚَ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻥَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻳَﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻮْﻕَ ﺃَﻳْﺪِﻳﻬِﻢْ
অর্থাৎ, হে রাসূল! যেসব লোক আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল, তারা আসলে আল্লাহর কাছেই বাইয়া’ত হচ্ছিল। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর (কুদরতের) হাত ছিল। (সূরা ফাতহা-১০)
ﻳَﺎﺍﻳٌﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰٌّ ﺍِﺫﺍ ﺟَﺎﺀَﻙَ ﺍﻟﻤُﺆﻣِﻨﺖِ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌْﻧَﻚَ -
অর্থাৎ, হে রাসূল (দ:)! যে সকল মু’মিন মহিলারা আপনার কাছে বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে (মুরিদ হওয়ার জন্য আসে), তাঁদেরকে আপনি বাইয়া’ত দান করুন। (সূরা মুমতাহানা: ১২)
হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আওফ বিন মালেক আশ’আরী (রা:) বলেন, আমরা ৯ জন কিংবা ৮ অথবা ৭ জন নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। হযরত নবী করীম (দ:) বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইয়া’ত হবে না? আমরা নিজ নিজ হাত প্রসারিত করে দিলাম এবং বললাম, হে আল্লাহ’র রাছুল (দ:) কোন বিষয়ের বাইয়া’ত হবো? নবী পাক (দ:) বললেন, এ বিষয়ের ওপর যে তোমরা আল্লাহ পাকের এবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করবে এবং যাবতীয় হুকুম-আহকাম শুনবে ও মান্য করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ ও নাছাই শরীফ)
অন্য হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে –
ﻭَ ﻣَﻦ ﻣَﺎﺕَ ﻭَ ﻟَﻴﺲَ ﻓﻰِ ﻋُﻨُﻘِﻪِ ﺑَﻴﻌَﺔُ ﻣَﺎﺕَ ﻣِﻴﺘَﺔَ ﺟَﺎﻫِﻠِﻴَّﺔُ -
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো যে, তার গর্দানে বাইয়া’তের (আনুগত্যের) বেড়ি থাকলো না, সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যু বরণ করলো। (মুসলীম শরীফ: কিতাবুল ইমারা, হাদীছ নং-৪৮৯৯)।
পীর মাশায়েখগণের মধ্যে বাইয়া’ত করার যে প্রথা প্রচলিত তার সারমর্ম হলো জাহেরী ও বাতেনী আমলের ওপর দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং গুরুত্ব প্রদান করার অঙ্গীকার করা। তাঁদের পরিভাষায় একে বাইয়া’তে তরীকত, অর্থাৎ, তরীকতের কাজ বা আমল করার অঙ্গীকার করা। কেউ কেউ এ বাইয়া’তকে অস্বীকার করে থাকেন। কারণ হিসেবে বলেন যে হুজুর পাক (দ:) হতে তা বর্ণিত নেই। তখন শুধু কাফেরদেরকে ইসলামের বাইয়া’ত করার দরকার ছিল। কিন্তু উল্লেখিত হাদীছ শরীফে এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তাই অনেক ইমাম মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন- ﻣﻦ ﻟﻴﺲ ﻟﻪ ﺷﻴﺦ ﻓﺸﻴﺨﻪ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ ‘মান লায়ছা লাহু শায়খুন ফা-শায়েখুহুশ শয়তানুন’ ( জুনায়েদ বাগদাদী রহ:)। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো হাক্কানী পীর বা শায়েখের বাইয়া’ত গ্রহণ করেনি, তার শায়খ বা ওস্তাদ হয় শয়তান। শয়তান-ই তাকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করে দেয়। কাজেই গোমরাহী থেকে বাঁচা যেহেতু ফরজ, সেহেতু পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর ঠিক এ কথাটি বলেছেন আমাদের হানাফী মজহাবের ইমাম, ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ:)। তিনি বলেন, “লাওলা ছানাতানি লাহালাকান নোমান”। অর্থাৎ, “আমি নোমান বিন ছাবিত যদি দু’টি বছর না পেতাম তবে হালাক হয়ে যেতাম”। অর্থাৎ, যদি আমি আমার পীর সাহেব ইমাম জাফর সাদেক (রা:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে দু’টি বছর অতিবাহিত না করতাম, তবে আত্মশুদ্ধি লাভ না করার কারণে গোমরাহ ও হালাক (ধ্বংস) হয়ে যেতাম।
আর বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও আলেমকুল শিরোমণি বিশিষ্ট সুফি সাধক হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহ:) বলেন –
“মাওলানা রুম হারগেজ কামেল নাশুদ; তা গোলামে শামছে তিবরীজ নাশুদ”
অর্থাৎ, আমি মাওলানা রুমী ততোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ-ওয়ালা হতে পারিনি যতোক্ষণ পর্যন্ত আমার পীর হযরত শামছে তাবরীজ (রহ:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমল করে এখলাছ হাছিল না করেছি। অর্থাৎ, এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে এখলাছ অর্জন করার পরই আমি হাকীকি মু’মিন হতে পেরেছিলাম (মসনবী)।
তাই কাদেরীয়া তরীকার ইমাম হযরত গাউছুল আযম মাহবুবে ছোবহানী কুতুবে রব্বানী গাউছে সামদানী শায়খ মহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কেতাব “সিররুল আসরার”-এর ৫ম অধ্যায়ে তওবার বয়ানে লিখেছেন, ক্বলব বা অন্তরকে জীবিত বা যাবতীয় কু-রিপু হতে পবিত্র করার জন্য আহলে তালকীন তথা পীরে কামেল গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। কারণ তাওহীদের রত্ন (বীজ) কোনো যোগ্য মুর্শিদের অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে।
হাদীস শরীফে যে এলেম অর্জন করা ফরজ বলা হয়েছে তা দ্বারা এলমে মারেফাত ও কোরবতকেই বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও অন্যান্য সর্বজনমান্য ও সর্বজনস্বীকৃত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়া ই-কিরামগণ (রহ:) পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ:) তাঁর “এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ও কিমিয়া সায়াদাত” কিতাবে, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমেরী (রহ:)-এর মালফুজাত “আনিসুল আরওয়াহ” কিতাবে, ইমামুশ শরীয়াত ওয়াত তরীকত শায়খ আবুল কাশেম কুশাইরী (রহ:) “রিছালায়ে কুশাইরিয়া” কিতাবে, হযরত মাওলানা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (রহ:) “মালাবুদ্দা মিনহু ও এরশাদুত্তালেবীন” কিতাবে, শাহ আব্দুল আজিজ মহাদ্দিস দেহলভী (রহ:) “তাফসীরে আজিজ” শীর্ষক কিতাবে, আল্লামা শামী (রহ:) “রদ্দুল মোখতার” কিতাবে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ:) তাঁর “তাফসীরে কবীর” কিতাবে, কাইয়্যুমে আউয়াল আফজালুল আউলিয়া হযরত ইমাম মোজাদ্দেদে আলফে ছানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত আল-“মাকতুবাত শরীফে”, হযরত ইমাম আহমদ রেফায়ী (রহ:) তাঁর “বুনইয়ানুল মুআইয়্যাদ” কিতাবে, হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) “তাফসীরে রুহুল বয়ানে” সরাসরি পীর গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতুয়া দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কারামত আলী জৌনপুরীও তার “যাদুত তাকাওয়াতে” লিখেছে যে এলমে তাছাউফ ছাড়া ইলমে শরীয়তের ওপর যথাযথ আমল করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সুতরাং ছাবেত হলো যে এলমে মারেফত চর্চা করা সকলের জন্যই ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। আর এই এলেমে তাছাউফ পারদর্শী মুর্শিদে কামেল-এর সোহবত ও তা’লীম ব্যতিরেকে অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়।
হাটহাজারী খারিজিদের মুরুব্বী মুফতী শফি সাহেব স্বয়ং নিজেই “মা’আরেফুল কুরআনে” সূরা বাক্বারায় উক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে লেখেন, আত্মশুদ্ধি অর্জিত হবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত এছলাহ-প্রাপ্ত কোনো বুর্যুর্গ বা পীরে কামেলের অধীনে থেকে তালীম ও তরবিয়াত হাসিল না করবে। আমল করার হিম্মত তাওফিক কোনো কিতাব পড়া ও বোঝার দ্বারা অর্জিত হয় না, তা অর্জন করার একটি-ই পথ; আর তা হলো অলীগণের সোহবত তথা সান্নিধ্য।
পীর-মুর্শিদগণই হচ্ছেন হাকীকি আলেম। কেননা, পীর-মুর্শিদগণই এলমে শরীয়ত ও মারেফত, এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। আর উক্ত উভয় প্রকারের এলমের অধিকারীগণই হচ্ছেন হাদীছ শরীফের ঘোষণা অনুযায়ী- ﺍﻟﻌﻠﻤﺎﺀ ﻭﺭﺛﺔ ﺍﻻﻧﺒﻴﺎﺀ প্রকৃত আলেম বা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া। যেমন এ প্রসঙ্গে ইমামে রব্বানী মাহবুবে সুবহানী কাইয়ূমে আওয়াল সুলতানুল মাশায়েখ হযরত মোজাদ্দেদ আলফে ছানি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কিতাব ’মকতুবাত শরীফে’ উল্লেখ করেন, আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। এ হাদীস শরীফে বর্ণিত আলেম তারাই যাঁরা নবীগণের রেখে যাওয়া এলমে শরীয়ত ও এলমে মারিফত এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। অর্থাৎ, তিনি-ই প্রকৃত ওয়ারিছ বা স্বত্বাধিকারী। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক প্রকারের এলমের অধিকারী, সে নবীগণের প্রকৃত ওয়ারিশ নয়। কেননা, পরিত্যক্ত সম্পত্তির সকল ক্ষেত্রে অংশিদারী হওয়াকেই ওয়ারিছ বলে। আর যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোনো নির্দিষ্ট অংশের অধিকারী হয়, তাকে ’গরীম’ বলে। অর্থাৎ, সে ওয়ারিছ নয়, গরীমের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, যারা পীর-মাশায়েখ নয়, অর্থাৎ, শুধু এলমে শরীয়তের অধিকারী ও এলমে তাছাউফ-শূন্য, তারা প্রকৃত আলেম নয়।
অতএব, প্রমাণিত হলো, হক্কানী পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রকৃত বা খাঁটি আলেমে দ্বীন। ক্বলব জারি করতে হলে তাঁদের কাছে যেতে হবে। যে ব্যক্তি কোনো পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করে খিলাফত প্রাপ্ত হয়নি, তার কাছে বাইয়া’ত হওয়া অনুচিত।
****
অতএব, আত্মশুদ্ধি ও এলমে তাছাউফ অর্জন করা যেহেতু ফরজে আইন, আর কামেল পীর-মাশায়েখ ছাড়া এলমে তাছাউফ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, সেহেতু একজন কামেল পীর-মুর্শিদ অন্বেষণ করে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ। এটাই গ্রহণযোগ্য, বিশুদ্ধ ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া। এর বিপরীত মত পোষণকারীরা বাতিল ও গোমরাহ।
No comments