বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম:
বাংলাদেশে বিশেষত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী রয়েছে। চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ইত্যাদি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত।
"বুদ্ধ" ও "গৌতম" শিরোনামকে এখানে পুনর্নির্দেশ করা হয়েছে। বৌদ্ধ উপাধির জন্য বুদ্ধ (উপাধি) দেখুন। অন্য ব্যবহারের জন্য বুদ্ধ (দ্ব্যর্থতা নিরসন) ও গৌতম (দ্ব্যর্থতা নিরসন) দেখুন।
গৌতম বুদ্ধ হলেন বৌদ্ধধর্মের ২৮তম বুদ্ধ ও একজন সম্যাক সম্বুুদ্ধ (তপস্বী) ও জ্ঞানী, যাঁর তত্ত্ব অনুসারে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম, শাক্যমুনি বুদ্ধ অথবা ‘বুদ্ধ’ উপাধি অনুযায়ী শুধুমাত্র বুদ্ধ নামেও পরিচিত। অনুমান করা হয়, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬২৫ অব্দে একদা প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে জীবিত ছিলেন এবং শিক্ষাদান করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ ভোগবাসনা চরিতার্থ-করণ এবং তার অঞ্চল জুড়ে প্রচলিত শ্রমণ আন্দোলনের আদর্শ অনুসারে অনুসারীদের কঠোর তপস্যার মধ্যে মধ্যপন্থা শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মগধ এবং কোশলসহ পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও শিক্ষাদান করেছিলেন। তিনি মিথ্যাদৃষ্টি, অজ্ঞানতা, তৃষ্ণা, পুনর্জন্ম এবং কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে পরম সুখ নির্বাণের পথ শিখিয়েছিলেন।
বৌদ্ধরা তাকে সেই বোধিপ্রাপ্ত বা দিব্য শিক্ষক মনে করে, যিনি সম্পূর্ণ বুদ্ধত্ব অর্জন করেছেন এবং নিজের অন্তর্দৃষ্টির কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে চেতন সত্ত্বাদের পুনর্জন্ম এবং দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করেছেন। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন যে গৌতম বুদ্ধের জীবনকাহিনী, কথোপকথনের বিবরণ, সন্ন্যাস নিয়মাবলী তার মৃত্যুর পর হতে সঙ্গায়নের মাধ্যমে বুদ্ধের বাণী সংরক্ষণ করে রাখতেন। ইতিহাসে এ রকম এই পর্যন্ত ছয়টি সঙ্গায়ন হয়েছে। প্রথম সঙ্গায়ন হয় বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর রাজা অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের সপ্তপর্ণী গুহায় এবং এর দ্বিতীয়টি হয় বৈশালীতে কালাশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় । তৃতীয়টি হয় সম্রাট অশোক মৌর্যের পৃষ্ঠপোষকতায়। এভাবে বড় বড় রাজা ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপিটক বুদ্ধবচন সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
ঐতিহাসিক সিদ্ধার্থ গৌতম
বুদ্ধের সমসাময়িক প্রাচীন ভারতের রাজ্য ও শহরগুলির মানচিত্র
বুদ্ধের জীবনের ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে কোনও প্রকার দুর্বল দাবি উত্থাপন করতে গবেষকরা দ্বিধাবোধ করেন। তাদের অধিকাংশই মেনে নিয়েছেন যে, বুদ্ধ মহাজনপদের যুগে মগধ সাম্রাজ্যের শাসক বিম্বিসারের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন, শিক্ষাদান করেছিলেন এবং একটি ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (আনু. ৫৫৮ – আনু. ৪৯১ BCE), তার মৃত্যু হয়েছিল বিম্বিসারের উত্তরসূরি অজাতশত্রু শাসনকালের প্রথম দিকে। সেই হিসেবে বুদ্ধ ছিলেন জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের কনিষ্ঠ সমসাময়িক। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ ছাড়াও বুদ্ধের জীবন ছিল আজীবক, চার্বাক, জৈনধর্ম ও অঞ্জন প্রভৃতি প্রভাবশালী শ্রমণ চিন্তাধারার উদয়কালের সমসাময়িক। দীর্ঘ নিকায় গ্রন্থে ব্রহ্মজাল সুত্রে এই ধরনের বাষট্টিটি মতবাদের কথা বিবৃত হয়েছে। সেই যুগেই মহাবীর, পূরণ কস্সপ, মক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত প্রমুখ প্রভাবশালী দার্শনিক তাদের মত প্রচার করেছিলেন। পিটকে সামান্নফল সুত্র এঁদের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বুদ্ধ নিশ্চয় এঁদের মতবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বুদ্ধের প্রধান দুই শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়ন প্রথম জীবনে ছিলেন সংশয়বাদী সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্তর প্রধান শিষ্য। ত্রিপিটকে প্রায়শই দেখা যায় যে, বুদ্ধ তার প্রতিদ্বন্দ্বী মতধারার সমর্থকদের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন। অর্থাৎ, বুদ্ধ নিজেও ছিলেন সমসাময়িক কালের অন্যতম শ্রমণ দার্শনিক। এমনও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্ত নামে দুই দার্শনিকও ঐতিহাসিক চরিত্র। বুদ্ধের জীবনকথায় “জন্ম, বয়ঃপ্রাপ্তি, সন্ন্যাসগ্রহণ, আধাত্মিক অনুসন্ধান, বোধিলাভ, শিক্ষাদান ও মহাপরিনির্বাণ”র ধারাটি সাধারণভাবে স্বীকৃত হলেও, প্রথাগত জীবনীগ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে মতৈক্য খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার অধিকাংশ ঐতিহাসিক ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে তাঁর জীবনকাল হিসেবে নিরূপণ করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধের জীবনীর ওপর আয়োজিত একটি সম্মেলনে অধিকাংশের বক্তৃতায় ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের নিকটবর্তী বছরগুলির মধ্যে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের সময়কাল বলে নিরূপণ করেন। এই বিকল্প মতবাদগুলি সমস্ত ঐতিহাসিকদের দ্বারা স্বীকৃত নয়।
প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্য জনগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মূল ভূখণ্ড থেকে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র গণতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র হিসেবে শাসন করত। সিদ্ধার্থ গৌতমের পিতা শুদ্ধোধন একজন নির্বাচিত গোষ্ঠীপতি ছিলেন, যার ওপর রাজ্যশাসনের দায়িত্ব ছিল। বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুসারে, গৌতম অধুনা নেপালের লুম্বিনী নগরে জন্মগ্রহণ করেন ও কপিলাবস্তুতে বড় হয়ে ওঠেন। প্রায় দুই শতাব্দী পরে সম্রাট অশোক গৌতমের জন্মস্থানে তীর্থ করতে গিয়ে লুম্বিনীতে স্তম্ভ স্থাপন করেন। এবং গৌতমের স্মৃতিবিজরিত স্থানগুলোতে তীর্থ যাত্রা করে সম্রাট স্তম্ভ, বিহার নির্মাণ করেন। তার অন্য একটি স্তম্ভে বিভিন্ন ধম্ম পুথির উল্লেখ রয়েছে, যার দ্বারা মৌর্য যুগে লিখিত বৌদ্ধ ঐতিহ্যের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদের নিকটে হাড্ডা হতে আবিষ্কৃত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে গান্ধারী ভাষায় রচিত ও খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত সাতাশটি বার্চের ছালের গান্ধার বৌদ্ধ পুঁথিগুলি বর্তমানে টিকে থাকা বৌদ্ধ পুঁথিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম।
No comments