Header Ads

ওরস শরীফ কী? ইসলামী শরীয়তের আলোকে বিশ্লেষণ

 

 ‘ওরস শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে, যার অর্থবিবাহ কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের সুফি সংস্কৃতিতেওরসবলতে সাধারণত কোন অলি বা বুজুর্গ ব্যক্তি ইন্তেকাল করলে তার মৃত্যুদিবসে আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানকে বোঝায়। অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর দিন ছিল তারআল্লাহর সঙ্গে মিলনের দিন

বুযুর্গগানে দ্বীন-এর ওফাত দিবসকেওরসবলা হয়। এর ভিত্তি হাদীসে পাকে বর্ণিত আছে, মুন্কার নাকীর যখন মৃত ব্যক্তির কবরে এসে প্রশ্ন করবে, তখন ওই প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদান করতে সক্ষম হলে মৃত ব্যক্তিকে বলা হয়- ওই দুলহানের মত ঘুমিয়ে পড়, যাকে পরিবারে তার প্রিয়তম ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ জাগাবে না। ওই দিন মুন্কার নাকীর ফিরিশ্তাদ্বয় তাকেআরূস’ ( ﻋَﺮُﻭْﺱ ) নামে আখ্যায়িত করে। জন্য ওই ওফাত দিবসকেওরস’ ( ﻋُﺮْﺱ) বলা হয়

অথবা মৃত ব্যক্তি নেক্কার হওয়ার কারণে বিশেষ করে বুযুর্গ হওয়াতে কবরের মধ্যে হুযূর- আক্রাম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হবে, যখন মুন্কার নাকীর জিজ্ঞাসা করবেন- হুযূর- আক্রাম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে ইশারা করে বলেন, নূরানী সত্তা সম্পর্কে তুমি কি আক্বীদা পোষণ করতে? তখন ওই ব্যক্তি দীদারে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পেয়ে আত্মহারা হয়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসামূলক উত্তর দেবে। উভয় জাহানের সরদারের দীদার লাভ করে ধন্য হওয়াতে ওই সময় ওই ব্যক্তির জন্য অনেক আনন্দের মুহূর্ত হয়। তাই ওই দিনকেওরস’ ( ﻋُﺮْﺱ)-এর দিন বলা হয়

ওরস পালনের উদ্দেশ্য কী?

  • অলিদের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা প্রকাশ
  • তাদের ইসলাম প্রচারের অবদান স্মরণ
  • তাদের জীবন শিক্ষা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ
  • কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, দোয়া মাহফিল ইত্যাদির আয়োজন

শরীয়তের আলোকে ওরসের ভিত্তি

সমর্থনের দিককিছু আলেম সুফি মতবাদ মতে:

যদি ওরসে কোন বিদআত বা শরীয়ত-বিরোধী কাজ না হয় এবং তা শুধু দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত, সদকা, ইসলামী আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে এটি একটি মুস্তাহাব (ভালো) কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে

প্রতি বছর ওফাত দিবসে মৃত ব্যক্তি কবর বা আউলিয়া- কেরামের মাযার যিয়ারত করা, ক্বোরআন তিলাওয়াত, সাদ্ক্বা-খায়রাত, হালাল পশু যবেহ করে তাবাররুকের ব্যবস্থা করা হয়। সমস্ত কাজওরসউপলক্ষে করা হয়। শরীয়ত মতে এসব কর্মসূচি শুধু বৈধ নয়, বরং অনেক সাওয়াবের কাজও

শায়খ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি বর্ণনা করেন, অনেক লোক একত্রিত হয়ে খতমে ক্বোরআন করবে, খাবার শিরনী পাক করে ফাতেহার মাধ্যমে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে বন্টন করবে। যদিও কাজ হুযূর- করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খোলাফা- রাশেদীনের যুগে ছিলোনা; কিন্তু এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই; বরং এতে জীবিত মৃত সকলেরই উপকার সাধিত হয়

মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্মৌভী বর্ণনা করেন যে- শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি নিজ ওস্তাদের সূত্রে বর্ণনা করেন যে, প্রচলিত ওরস শরীফ সালফ- সালেহীনের যুগে না থাকলেও পরবর্তী ওলামা- কেরামের মতে মুস্তাহাসান, ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে সাব্যস্ত আমল

হযরত গাযী- দ্বীন মিল্লাত আল্লামা আযীযুল হক্ব শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি তাঁর ফাতাওয়া- আযীযিয়াতে উল্লেখ করেন- মাওলানা জালালুদ্দীন বোখারী হাশিয়া- মাযহারীতেসিরাজুল হেদায়া বর্ণনা করেন, ওই সময়কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে, যখন বুযুর্গ বা মৃত ব্যক্তির রূহ কব্জ হয়েছে; কেননা। মৃতদের রূহ প্রত্যেক বছর ওরস চলাকালীন ওই সময়ে ওই স্থানে হাযির হয়। অতএব, সে সময় খাবার-তাবাররুকাত পরিবেশন করা দরকার। এতে তাদের রূহ আনন্দিত হয়

হাজী এমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী (দেওবন্দী আলিমদের পীর) ‘ফয়সালা- হাফতে মাসয়ালা ওরস বৈধ বলে জোর দিয়ে বলেন- ফক্বীর (নিজ)-এর বিষয়ে তরীক্বা এযে, আমি প্রত্যেক বছর আমার পীর-মুরশিদের এর জন্য ঈসালে সাওয়াবের ব্যবস্থা এভাবে করি যে, প্রথমে ক্বোরআন পাক তিলাওয়াত করা হয়। আর মাঝে মধ্যে সময়ানুপাতে মীলাদ শরীফও পাঠ করা হয়। এরপর উপস্থিত সবাইকে খাবার তাবাররুক হিসাবে বিতরণ করা হয়

দলীলসমূহ:

স্মরণ দোয়া বৈধতা: "তোমরা সৎকর্মশীলদের সঙ্গ গ্রহণ করো" সূরা আত-তাওবা, :১১৯

মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া: তোমরা তোমাদের ভাইদের জন্য দোয়া করো যখন তারা মারা যায়।” — সহীহ মুসলিম

ইতিহাসে নজির: ইসলামি ইতিহাসে অনেক বড় আলেম বুজুর্গদের মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া আলোচনার প্রথা ছিল, বিশেষ করে সুফি ধারায়

হুযূর- আক্রাম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট তারিখে উহুদের শোহাদা- কেরামের মাযারে হাযির হতেন এবং তাদেরকে সালাম পেশ করে দো করতেন। খোলাফা- রাশেদীনও আমল করতেন

এছাড়া হাদীস- পাকে আরো উল্লেখ আছে- নবীগণের আলোচনা ইবাদত, নেককার বান্দাদের আলোচনা কাফ্ফারা, মৃত্যুকে স্মরণ করা, সদক্বাহ্ এবং কবরের আলোচনা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটস্থ করে দেয়

সেখানে খাবার হিসাবে তাবাররুক বিতরণ করা হয়। অপরকে খাবার পরিবেশন সম্পর্কে হাদীসে পাকে বর্ণিত আছে- ইসলামের উত্তম কাজ খানা খাওয়ানো এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে অধিক হারে সালাম দেয়া এটাও এরশাদ করেছেন- তোমরা খানা খাওয়াও, বেশি পরিমাণে সালাম দাও, তাহলে বেহেশতের মালিক হয়ে যাবে। (ঈমানদারদের জন্য)

ওরসে পাকে উপস্থিত ব্যক্তিরাই হলো মেহমান, আর মেহমানদের অভ্যর্থনা আপ্যায়ন করা ঈমানের পরিপূর্ণতা। যেমন হাদীসে পাকে উল্লেখ রয়েছে-  যে আল্লাহ্ আখিরাতের উপর ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের সমাদর করে

উপরোক্ত আমলসমূহের সমন্বয়ে ওরসে পাক উদ্যাপিত হয়, তাই ওরস পালন ইসলামের অনুষ্ঠানাদি পালনের মধ্যে অন্যতম এবং সাওয়াবের কাজ

বিরোধিতার দিকঅন্য আলেমদের মত:

অনেকে মনে করেন, ওরস পালনের প্রথা রাসূল (সাঃ), সাহাবা বা তাবেঈনের যুগে ছিল না। তাই এটিকে বিদআত (নব উদ্ভাবিত ইবাদত) বলা হয়, যদি:

  • এটি ধর্মীয় আবশ্যকতা বা সওয়াবের বিশ্বাসে করা হয়
  • এতে কবরপূজা, গান-বাজনা, নারী-পুরুষের মেলামেশা হয়
  • মাজারে তওয়াফ বা কবর থেকে কিছু চাওয়া হয়

উপসংহার (সতর্ক ভারসাম্য)

পন্থা

বৈধতা

শর্ত

কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইসলামি আলোচনা

বৈধ

বিদআত-মুক্ত হওয়া

কবরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ, চাদর, গান-বাজনা

অবৈধ

ইসলাম বিরুদ্ধ শিরক আশঙ্কা

উপরোল্লিখিত দলীলাদির আলোকে সাব্যস্ত হল যে, ওরস শরীফ পালন করা ইসলামী অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত। এটা শুধু জায়েয নয়; বরং সাওয়াবের কাজ ওই অনুষ্ঠানে প্রথমে যিয়ারত করা হয়। আর যিয়ারত করা ক্বোরআন-সুন্নাহ্ দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস- পাকে রাসূল- করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- আমি তোমাদেরকে প্রথমে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা যিয়ারত কর। কেননা, এটা দুনিয়া বিমুখতাকে বাড়িয়ে দেয় এবং আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়


No comments

Powered by Blogger.