মিরাজের ঘটনা ও ইতিহাস
মিরাজ একটি অলৌকিক এবং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা ইসলামের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি ছিল এমন একটি রাত, যখন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে আসমানসমূহ পাড়ি দিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত আরোহন করেন এবং সরাসরি আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। এই ঘটনাটি মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী বাস্তব ও দৈহিকভাবে সংঘটিত হয়েছিল।
মিরাজের অর্থ ও ধারা
মিরাজ শব্দটি আরবি ‘উরূজ’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘উচ্চে ওঠা’ বা ‘আরোহণ’। এ ঘটনার দুটি অংশ আছে:
ইসরা (الإسراء):
রাত্রির এক অংশে মহানবী (সা.)-কে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস (মসজিদুল আকসা) পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়।
মিরাজ (المعراج):
সেখান থেকে তিনি সাত আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত যান এবং আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন।
ইতিহাস ও সময়কাল
মিরাজের ঘটনা হিজরতের প্রায় এক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়, অর্থাৎ নবুওতের দশম বছর। এই বছরকে ইসলামী ইতিহাসে ‘আমুল হুযন’ বা ‘দুঃখের বছর’ বলা হয়, কারণ এ বছরই মহানবী (সা.) তাঁর প্রিয় স্ত্রী খাদিজা (রা.) এবং চাচা আবু তালিবকে হারান। এই কঠিন সময়ে আল্লাহ তাআলা নবীজিকে সান্ত্বনা দিতে ও নবুয়তের মর্যাদা তুলে ধরতে তাঁকে মিরাজে নিয়ে যান।
সাত আসমান ও নবীদের সাক্ষাৎ
মিরাজের সময় তিনি একে একে সাত আসমান অতিক্রম করেন এবং প্রত্যেক আসমানে বিভিন্ন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন:
১ম আসমানে: আদম (আ.)
২য় আসমানে: ঈসা (আ.) ও ইয়াহইয়া (আ.)
৩য় আসমানে: ইউসুফ (আ.)
৪র্থ আসমানে: ইদরিস (আ.)
৫ম আসমানে: হারুন (আ.)
৬ষ্ঠ আসমানে: মূসা (আ.)
৭ম আসমানে: ইবরাহিম (আ.)
এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছান, যা সৃষ্টি জগতের সর্বোচ্চ সীমা।
আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও নামাজ ফরজ
সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে মহানবী (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই আল্লাহ তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন। প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত নির্ধারিত হলেও মূসা (আ.)-এর পরামর্শে নবীজী বারবার অনুরোধ করেন এবং শেষে তা ৫ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়, যা মূলত ৫০ ওয়াক্তেরই সমতুল্য।
মিরাজের তাৎপর্য
এটি নবুয়তের সর্বোচ্চ সম্মান ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি।
আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ।
মুসলমানদের জন্য নামাজের হুকুমের সূচনা।
আখেরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা।
কুরআনে মিরাজ
মিরাজের ইসরা অংশ পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা ও মিরাজ অংশ সূরা আন-নাজমে উল্লেখিত হয়েছে: “পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রির কিছু অংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করালেন, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি।”
— (সূরা আল-ইসরা: ১)
উপসংহার
মিরাজ ইসলামের একটি অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক দিক উন্মোচন করে। এটি একদিকে নবী করিম (সা.)-এর মর্যাদা প্রকাশ করে, অপরদিকে মুসলমানদের নামাজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই ঘটনার প্রতি বিশ্বাস রাখা ও তার শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
No comments