মাইজভান্ডারী তরিকার উসুলে সাবআ বা সপ্ত পদ্ধতি:
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর:
১. প্রথম স্তর - রিপু বা শত্রু শক্তির প্রথম স্তর (নফস বা আত্ম):
প্রথম স্তরে, শিষ্যকে তার নফস (অন্তরাত্মা বা মনের খারাপ প্রবৃত্তি) বা আত্মবিশ্বাসের বিভ্রান্তি ধ্বংস করতে হয়। মানুষের অন্তরে অহংকার, লোভ, প্রতিহিংসা, গর্ব, এবং দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা প্রাধান্য পায়, যা তাকে আধ্যাত্মিক উন্নতি থেকে বাধা দেয়। এই স্তরে, শিষ্যকে নিজের নফস বা মনের অশুদ্ধতা, অপবিত্রতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা মুছে ফেলতে হয়। শিষ্যকে নিজের অহংকার, ইগো এবং দুনিয়াবি প্রাধান্য পরিত্যাগ করতে হবে, যাতে সে সত্যিকার অর্থে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।
২. দ্বিতীয় স্তর - রিপু বা শত্রু শক্তির দ্বিতীয় স্তর (শয়তান):
দ্বিতীয় স্তরে শিষ্যকে শয়তান বা খারাপ প্রবৃত্তির প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হয়। শয়তান মানুষের অন্তরে খারাপ চিন্তা এবং প্রলোভন সৃষ্টি করে, যা তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। এই স্তরে, শিষ্যকে শয়তানের সকল প্ররোচনাকে পরাজিত করতে হবে এবং আল্লাহর স্মরণে এক-minded হতে হবে। শিষ্যকে তার অন্তরের খারাপ চিন্তা এবং ইচ্ছাগুলো পরিত্যাগ করতে হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সচেষ্ট থাকতে হয়।
৩. তৃতীয় স্তর - রিপু বা শত্রু শক্তির তৃতীয় স্তর (দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা):
তৃতীয় স্তরে, শিষ্যকে দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। দুনিয়ার সমস্ত বিষয়কে তিনি আল্লাহর পথে নিবেদন করেন এবং জীবনকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত করতে শেখেন। এ স্তরে, শিষ্য তার দুনিয়াবি চাহিদা, পদমর্যাদা, এবং পৃথিবীজুড়ে খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এক-mindedভাবে কর্মশক্তি নিবেদন করেন।
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তরের উদ্দেশ্য:
এই ত্রিবিধ স্তরের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিষ্য তার সমস্ত রিপু বা শত্রু শক্তির প্রভাবে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করে আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ফানায়ে ছালাছা শিষ্যকে তার অন্তরের সকল অশুদ্ধতা ও দূষিত প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে, যাতে সে আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর সঠিক পথে চলতে পারে।
উপসংহার:
মাইজভান্ডারী তরিকার ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর শিষ্যকে তার অন্তরাত্মার শুদ্ধতা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রদর্শন করে। এই স্তরগুলো অনুসরণ করে শিষ্য তার নফস, শয়তান এবং দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সফল হতে পারে। এই পদ্ধতি একটি অত্যন্ত উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং সাধনার ফলস্বরূপ, যা শিষ্যের জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে এবং তাকে সত্যিকার শান্তি ও শুদ্ধতার দিকে পরিচালিত করে।
মাউতে আর’বা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু:
মাইজভান্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক শিখনে মাউতে আর’বা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু একটি অত্যন্ত গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি একজন শিষ্যের আধ্যাত্মিক যাত্রায় প্রবৃত্তি বা আত্মার চারটি প্রধান অঙ্গীকার বা মৃত্যুকে পরাস্ত করার প্রক্রিয়া। এই মৃত্যু শিষ্যকে আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা এবং পরিপূর্ণ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সহায়তা করে।
এটি মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত, যার মাধ্যমে শিষ্য তার মনের অশুদ্ধতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষাগুলো থেকে মুক্তি পায়। আসুন এই চতুর্বিধ মৃত্যুর স্তরগুলো বিশদভাবে জানি:
১. মৃত্যু (আল-মাউত) - প্রথম স্তর: নফস বা আত্মের মৃত্যু:
প্রথম স্তরে শিষ্যকে তার নফস (আত্মা বা মনের খারাপ প্রবৃত্তি) পরাস্ত করতে হবে। নফস হলো মানুষের মধ্যে থাকা অহংকার, গর্ব, দুনিয়াবি চাহিদা এবং খারাপ প্রবৃত্তি, যা তাকে আধ্যাত্মিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। এই স্তরে শিষ্যকে তার আত্মকেন্দ্রিকতা পরিত্যাগ করতে হবে এবং আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
এটি একটি "মৃত্যু" হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ শিষ্য তার নিজস্ব ইচ্ছা এবং অহংকারকে হত্যা করে একে অন্যের সেবা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনযাপন শুরু করে।
২. দ্বিতীয় স্তর: শয়তানের মৃত্যু:
দ্বিতীয় স্তরে শিষ্যকে শয়তান বা খারাপ চিন্তা এবং প্রলোভন থেকে মুক্তি পেতে হয়। শয়তান মানুষের অন্তরে খারাপ চিন্তা, গোপন অহংকার এবং অসত্যের প্রভাব বিস্তার করে। এই স্তরে শিষ্যকে শয়তানের প্ররোচনাকে ধ্বংস করতে হবে এবং তার মনের মধ্যে সমস্ত খারাপ চিন্তা ও প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করতে হবে। শিষ্য তার মন ও হৃদয়কে শুদ্ধ করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করতে শেখেন।
৩. তৃতীয় স্তর: দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু:
তৃতীয় স্তরে শিষ্যকে দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা বা পৃথিবীর সামগ্রীক চাহিদা থেকে মুক্তি পেতে হয়। দুনিয়া, প্রপঞ্চ এবং পৃথিবীর খ্যাতি, অর্থ, সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আসক্তি শিষ্যকে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের পথে বাধা দেয়। এই স্তরে শিষ্য তার দুনিয়াবি ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে পরিত্যাগ করে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনযাপন করতে শিখেন।
৪. চতুর্থ স্তর: আত্মিক আত্মসমর্পণের মৃত্যু:
চতুর্থ স্তরে শিষ্যকে তার আত্মিক আত্মসমর্পণ বা আল্লাহর সাথে সম্পর্কের সমস্ত সংকল্প এবং নিজস্ব ইচ্ছাগুলো বিলীন করতে হয়। এই স্তরে শিষ্য আল্লাহর সাথে একাত্ম হয়ে, নিজের সমস্ত কর্ম এবং চিন্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত করে। শিষ্য বুঝতে পারেন যে, তিনি একমাত্র আল্লাহর দয়া এবং রহমতের উপর নির্ভরশীল।
মাউতে আর’বা (প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু) এর উদ্দেশ্য:
এই চতুর্বিধ মৃত্যুর উদ্দেশ্য হলো, শিষ্য তার অন্তর, মন এবং আত্মাকে আধ্যাত্মিক দিক থেকে শুদ্ধ করতে পারে। শিষ্য তার খারাপ প্রবৃত্তি এবং দুনিয়াবি ইচ্ছাগুলিকে পরাজিত করে এক মহান আধ্যাত্মিক অবস্থানে পৌঁছান। এটি শিষ্যের জন্য আত্মনির্ভরতার একটি প্রক্রিয়া যেখানে সে আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর জন্য তার সমস্ত অশুদ্ধতা, মনোভাব এবং খারাপ প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে।
উপসংহার:
মাইজভান্ডারী তরিকার মাউতে আর’বা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু শিষ্যকে আধ্যাত্মিক ভাবে পরিশুদ্ধ এবং মহান অবস্থানে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিষ্য তার নফস, শয়তান, দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা, এবং আত্মিক সংকল্পের মৃত্যু ঘটিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সফল হয়। এটি একজন শিষ্যের আধ্যাত্মিক জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা তাকে সত্যিকারের শান্তি ও আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর পথ প্রদর্শন করে।
No comments